করোনাকালে শিশুর মানসিক বিকাশে আমাদের করণীয়

ড. রুমি শাইলা শারমিন

0
52

শিশুরা আনন্দ প্রবণ। কৌতুহলী মন তাদের। তাদের আছে এক বর্ণিল মনোজগৎ। এই শিশুরা আজ দীর্ঘ কয়েক মাস ঘরবন্দী। করোনা ভাইরাস থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে এখন তাদের সময় কাটছে গৃহ পরিবেশে। আগে স্কুলের শিক্ষকদের আদরে-শাসনে, ক্ল¬াসে পড়াশোনায়, বন্ধুবান্ধবের সাথে খেলাধুলায় মেতে উঠে সময় কাটতো। এখন স্কুল বন্ধ। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশী একে অপরের বাড়িতে যাতায়াতও নেই। প্রিয়জনদেরকে কাছে পাওয়া, গল্পগুজব করা বা ভালোবেসে আলিঙ্গনের কোনো সুযোগ-ও নেই। নিজ বাড়িতে ভালো রান্না হলে পাশের বাড়িতে দিয়ে আসা, ভাগাভাগি করে খাওয়া এসব নির্মল আনন্দ থেকেও বঞ্চিত হতে হচ্ছে। শিশুদের সপ্তাহ অন্তর বাবা-মায়ের সাথে বাইরে ঘুরে বেড়ানো,‌ বাইরের পরিবেশে মজার মজার খাবার খাওয়া-ও হচ্ছে না। শুধু ঘরের চার দেয়াল আর গৃহে পরিচিত মুখগুলোই এখন সঙ্গী। শিশুরা টেলিভিশনের পর্দায়, ল্যাপটপ বা মোবাইলকে কেন্দ্র করে অনলাইনের মাধ্যমে লেখাপড়া করছে। স্বাভাবিকভাবেই ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসের সাথে যুক্ত হতে হচ্ছে তারা। এরই প্রভাব পড়ছে বাকি সময়গুলোতেও। একঘেয়েমি ভর করছে। যারা একটু বড় তারা নিজের মনকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে, পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে চলতে চেষ্টা করছে। কিন্তু একেবারে অবোধ শিশু অনেক কিছুই বুঝতে পারছে না। তারা বড়দের মতো এতটা যুক্তি‌ সহকারে চিন্তা করতে পারে না। এত দিন ধরে যে নিয়মের আবর্তে তারা পৃথিবীর আলো বাতাসে বেড়ে উঠেছে হঠাৎ একটা পরিবর্তনীয় জীবন তাদের অবারিত ভাবনায় ছেদ ফেলেছে। স্কুলে যেতে না পারা, খেলাধুলা আর মানুষের সাথে যোগাযোগের বিচ্ছিন্নতা শিশুর মানসিক বিকাশে বিরাট অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনা কালে বিশ্বে ৯১ শতাংশ শিশু মানসিক চাপে আছে যা হুমকিস্বরূপ। অথচ এই শিশুরাই সুন্দর আগামী। এ সময় শিশুরা যে ধরনের মানসিক অবস্থায় ভুগছে বা শিশুর যে ধরনের আচরণ দেখা দিচ্ছে তা হলোÑ যেকোনো ব্যাপারে মনোযোগের অভাব, অতিমাত্রায় চঞ্চলতা বা একেবারেই নিরবতা। পরিবারের সদস্যদের সাথে উগ্র আচরণ, ইন্টারনেট আর মোবাইলের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার ও আসক্তি, হঠাৎ রেগে যাওয়া, যেকোনো কাজের প্রতি অনীহা, একাকীত্ব, করোনা সংক্রান্ত তথ্যে অতিমাত্রায় আতঙ্কিত বা ভীত হওয়া, জেদী হয়ে ওঠা, পড়াশোনায় মনোযোগের অভাব, বিষন্নতাসহ নানান রকম মানসিক সমস্যা।
এসব মানসিক সমস্যা থেকে মুক্ত থাকতে হলে প্রথমে এক এক করে চিহ্নিত করতে হবে সমস্যাগুলো। তারপর কোথায় বা কিসে শিশুর খারাপলাগা এবং ভালোলাগা সে বিষয় খুঁজে বের করতে হবে। পাশাপাশি করোনা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দিতে হবে। আতঙ্ক সৃষ্টি করে এমন খবরা-খবর অনবরত শোনা থেকে বিরত থাকতে হবে। জ্ঞান অর্জনের জন্য যতটুকু প্রয়োজন ওই টুকু খবর জানতে হবে এবং খেয়াল রাখতে হবে তা যেন শিশুর সহ্য সীমার মধ্যে হয়। প্রচুর পরিমাণে তাদের সঙ্গ দিতে হবে। অভিভাবকদেরকে যথেষ্ট ধৈর্যশীল ও সতর্ক হতে হবে। পারিবারিক কলহ এড়িয়ে চলতে হবে। শিশুকে বকাবকি বা অন্যের সাথে তুলনা করা ঠিক নয়। এতে শিশুরা হীনমন্যতায় ভোগে। পড়াশোনা নিয়ে খুব বেশি চাপ না দেয়াই ভালো। দৈনন্দিন জীবনে বৈচিত্র্য আনতে হবে যা ঘর থেকেও সম্ভব। যেমনÑ প্রতিদিন নিয়মিত নামাজ, জিকির, তেলাওয়াত বা নিজ নিজ ধর্মে যেসব ধর্মীয় নিয়মকানুনগুলো আছে সেগুলো পালন করা খুব জরুরী। নিয়মিত ধর্মীয় ধ্যান, মেডিটেশন, ইয়োগা, বিভিন্নরকম ব্যায়াম বা শরীরচর্চা মন ও শরীরকে প্রফুল্ল­ রাখে। এছাড়া বাগান তৈরি করে বাগানের যতœ পরিচর্যা, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ, শখ করে নিজের হাতে খাবার বানানো, ভালো ভালো বই পড়া, হাসির গল্প ও কৌতুক পড়ে পরিবারের সবাইকে শোনানো, পরিবারে সবাই মিলে একসাথে শিক্ষামূলক মুভি কিংবা ডকুমেন্টারি দেখা, গল্প আড্ডায় মেতে ওঠা নির্মল আনন্দ এনে দেবে। একঘেয়েমি দূর হবে। এখন প্রযুক্তির কল্যাণে নিত্যনতুন শিক্ষামূলক ও সৃজনশীল অনেক কোর্স সম্পন্নের সুযোগ আছে। বিভিন্ন ভাষা শিক্ষা, রান্না, সেলাই ও সৌখিন যেকোনো বিষয়ে কোর্স সম্পন্ন করা যেতে পারে। বাড়ির ফাঁকা জায়গায় বা ছাদে বনভোজন করেও অনেকে আনন্দ উপভোগ করছে। জরুরী প্রয়োজনে বাইরে যেতে হলে সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে মুখে মাস্ক ব্যবহার, হাত ধোয়া, বাইরে থেকে ফিরে গোসল করা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা, ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। এ সময় ফোনের মাধ্যমে একে অন্যের খোঁজখবর নেয়া বা কথাবার্তা বলতে পারলে যোগাযোগের অভাবে যে মন খারাপ হচ্ছে তা দূর হবে। এভাবে হৃদ্যতাও বাড়ানো সম্ভব। ঘরোয়া খেলাধুলায় সম্পৃক্ত হতে হবে। ছবি আঁকা, আবৃত্তি, গান শোনা বা গাওয়া এই ধরনের সৃজনশীল কাজের সাথে যুক্ত হলেও আনন্দ পাওয়া যায়। বিভিন্ন নি¤œ আয়ের মানুষ এখন বিপর্যস্ত, তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। অন্যের জন্য কিছু করতে পারাটাও উন্নত মানসিকতার পরিচয়। এতে আত্মতৃপ্তি বাড়ে। শিশুর পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশে শিশুদেরকে স্বাধীন চিন্তা চেতনার সুযোগ দিতে হবে‌‌। তবে অভিভাবকগণ খেয়াল রাখবেন স্বাধীনতার মাত্রা ততটুকু হবে যা শিশুদের ক্ষতির কারণ হবে না।

শিশুর কোনো আচরণ বা মানসিক অবস্থা যদি তার দৈনন্দিন স্বাভাবিক জীবন যাপনে ব্যাঘাত ঘটায়, ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে তাহলে মানসিক স্বাস্থ্য সেবার জন্য অভিভাবকগণ মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন গৃহে থেকেই। অনলাইন মাধ্যমে এ ব্যবস্থা আছে।
সর্বোপরি এই সংকটময় সময়ের সাথে শিশুরা সুষ্ঠু মোকাবেলা করে সুস্থ, সুন্দর থাকুক এবং পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশ ঘটিয়ে হয়ে উঠুক শক্তিশালী প্রজন্ম। এটাই কাম্য।