এক ঢিলে দু’পাখি

দেলোয়ার হোসেন

0
108

এই ঘটনাটা ঘটেছিল পাঞ্জাবে। পাঞ্জাব হলো পঞ্চনদীর দেশ। তো সেখানকার এক গ্রামে বাস করতো এক চাষি ও তার স্ত্রী। একদিন চাষির ঘরে সুন্দর একটি ছেলের জন্ম হলো। ছেলেটা দেখতে খুব সুন্দর। গ্রামের সবারই চোখ জুড়ানো।
কিন্তু সেবার আকাশে মেঘ দেখা দিলো না। বৃষ্টির অভাবে চাষবাস বন্ধ হয়ে গেল গাঁয়ের মানুষের। চাষি কিন্তু দমলেন না। দুঃখকষ্ট, বিপদে পাঞ্জাবিরা সহজে ভেঙে পড়ে না।
চাষি বলল, চাষ হবে না বলে আমি ঘরে বসে থাকবো না। তাই সে চলে গেল শহরে। চাষির ভাগ্য ভালো। শহরে গিয়ে জিনিসপত্র বেচাকেনা করে কিছুদিনের মদ্ধ্যেই তিনি অনেক পয়সা করে ফেললো। একদিন সে নিজের গ্রামে ফিরে এলো। চাষি তার স্ত্রীকে বলল, দুটো পয়সার মানুষ হয়েছি সে শুধু ছেলের কপাল গুণে।

চাষির ইচ্ছে হলো ছেলেকে বিয়ে দেবে। ছেলের বয়স কম হলেও তখন ছোট ছেলে মেয়েদের বিয়ের সম্বন্ধ হতো। বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়ে থাকত। ছেলে মেয়েদের বিয়ের বয়স হলেই তখন আনন্দ করে বিয়ে দেয়া হতো। তো অনেক দূরে এক বড় ঘরে ফুটফুটে এক মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে ঠিক হলো।
এর কয়েক বছর পর, চাষি ভাবল এবার ছেলের বিয়েটা করিয়ে বৌমাকে ঘরে নিয়ে আসি। কিন্তু চাষির ভাগ্যটা বড়ই খারাপ। হঠাৎ চাষি মারা গেল। কিছু দিন পর মেয়ের বাড়ি থেকে খবর এলো ছেলের বাবা যখন নেই তখন ছেলে, মেয়ের বাড়িতে এসে থাকুক। মেয়ের বাবা-ই সব দায়দায়িত্ব নেবে। কিন্তু ছেলের মা রাজি হলো না। সে বলল, আমার ছেলে বড় হয়েছে সে কেন মেয়ের বাড়িতে গিয়ে থাকবে। ঘোড়ার পিঠে করে শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়ে দেবো। বিয়ে করে নতুন বউ নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে টগবগিয়ে বাড়িতে আসবে। বিয়ানের এ কথায় মেয়ের বাবা আপত্তি করলেন না।

চাষির বউ ছেলেকে নওসা সাজিয়ে, ঘোড়ায় চড়িয়ে দিল। বলে দিলো, বিয়ে করে টুকটুকে বউ নিয়ে ফিরে এসো তাড়াতাড়ি। ছেলেও খুব সাহসী, একটুও ভয় পেল না। মায়ের কাছে বিদায় নিয়ে টগবগিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে তেপান্তরের মাঠের দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

ঘোড়া ছুটছে তো ছুটছেই। একটুও ক্লান্তি নেই। সূর্যের আলোয় বরের জামাকাপড় ঝলমল করছে। দূর থেকে মনে হয় কোনো রাজপুত্তুর পঙ্খীরাজের পিঠে চড়ে চলেছে রাজকন্যার দেশে। ঘোড়া ছুটতে ছুটতে ঢুকে পড়ল এক গভীর জঙ্গলের মধ্যে। সাহসী ছেলে ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছে একটানা।
হঠাৎ এক জায়গায় ঘোড়া থামালো চাষির ছেলে। সামনেই সাপ আর বেজির লড়াই চলছে। মস্তবড় সেই সাপ। ছেলেটির মনে পড়ল তার বাবার কথা। বাবা বলতেন, কোথাও যদি দেখ দু’জন মারামারি করছে, তখন দু’পক্ষকেই থামিয়ে দেওয়া ভদ্রলোকের কর্তব্য।
চাষির ছেলে সাপ ও বেজির যুদ্ধ থামিয়ে দিলো। কিন্তু বেজি সাপকে সহজে ছাড়তে রাজি নয়। তাই বেজি আবার সাপটাকে আক্রমণ করল। তা দেখে চাষির ছেলের খুব রাগ হলো আর তরবারি দিয়ে বেজিটাকে দু’টুকরো করে ফেলল। সময় নষ্ট না করে আবার সে ঘোড়া ছুটালো। বেশ কিছুটা এগুবার পর বুঝতে পারলো বিশাল সাপটা তার পেছনে তাড়া করে আসছে। ঘোড়া থামিয়ে পেছন দিকে তাকিয়ে সেই সাপটা দেখতে পেল। যে সাপটার প্রাণ সে বাঁচিয়েছে। এখন সে তাকেই গিলে খেতে চায়। তা কী করে হয়!
সাপটা বলল, এতে অবাক হবার কিছু নেই। যে দেশে যে নিয়ম। আমাদের দেশে এই নিয়ম; যদি কেউ উপকার করে তাহলে তার সর্বনাশ করতেই হবে। চাষির ছেলে বলল, আমাকে চারটা দিনের সময় দাও। শ্বশুরবাড়িতে আমার বিয়ের পর বউকে নিয়ে চার দিনের মাথায় ফিরে আসবো। তখন তুমি যা হয় করো।
কথা আদায় করে সাপ তখনকার মতো ছেলেটিকে ছেড়ে দিল। ঘোড়া আবার ছুটতে শুরু করল। মেয়ের বাড়িতে পৌঁছানোর পর খুব জাঁকজমকের সাথে ছেলেমেয়ের বিয়ে হয়ে গেল। সোনার পুতুলের মতো বউ। খুব পছন্দ হয়েছে তার। সবাই বলতে লাগলো কী সুন্দর মানিয়েছে। যেমন বর তেমন কনে।
চারদিন হইচই, গান-বাজনা করে কেটে গেল। এলো যাবার সময়। লাল বেনারসী শাড়িতে নতুন বউকে ছেলে তুলে নিল ঘোড়ার পিঠে। ঘোড়া এবার তীরের বেগে ছুটতে লাগল। ছুটতে ছুটতে ঘোড়া এসে গেল সেই বনের ধারে। তখন বউ দেখল স্বামীর কথাবার্তা কমে এসেছে। বনের মধ্যে ঘোড়া ঢুকে পড়ল। জীবনের শেষ মুহূর্ত আর দেরি নেই। একটু দূরেই সেই ভয়ঙ্কর সাপটা অপেক্ষা করছে তা ভুলবার কথা নয়। ব্যাপারটা আর গোপন না রেখে বিষণœকণ্ঠে ছেলেটি নতুন বউকে সব ঘটনা খুলে বলল। স্ত্রীকে সান্ত¡না দেয়ার বৃথা চেষ্টা করল সে। আমাকে সাপের হাতে ছেড়ে দিয়ে তুমি ঘোড়ার পিঠে চড়ে চলে যাও। আর তো কোনো উপায় নেই। এ জন্মে তোমায় কিছুই দিতে পারলাম না।
নতুন বউয়ের মনে তখন ভীষণ দুশ্চিন্তা, কিন্তু আচমকা বিপদে ভেঙে পড়বার মেয়ে সে নয়। নতুন বউ বলল, তোমাকে এখন একলা ছেড়ে দিয়ে কিছুতেই আমি যাচ্ছি না। আমি যাবো সাপের কাছে।

অবশেষে বিপজ্জনক সাপের সাথে দেখা হলো। চাষির ছেলেকে গিলে খাবার জন্য বিশাল বিভীষিকার মতো পথের ধারে সে অপেক্ষা করছে। গরম নিঃশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে এবার ছেলেটির দিকে এগিয়ে আসছে দেখে নতুন বউ দ্রæত স্বামীর সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
নতুন বউ নরম সুরে সাপকে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কেন আমার স্বামীর সর্বনাশ করতে চাইছেন? সাপটা তখন পুরনো কথা টেনে আনলো। তোমার স্বামী আমার উপকার করেছে, উপকারীর সর্বনাশ করাই আমাদের দেশের নিয়ম। বউ মাথায় হাত দিয়ে বলল, এরকম অদ্ভুত নিয়মের কথা তো কেউ কখনো শোনেনি। পৃথিবীতে সবাই-ই তো উপকারীর উপকার করার চেষ্টা করে।
সাপটা বলল, তোমার বয়স কম তুমি জানো না। যে দেশে যে নিয়ম তা হবেই। বউ নাছোড়বান্দা। সে বলল, উপকারীর ভুলেও ক্ষতি করতে নেই। শেষে সাপ বলল, ওই যে সারি সারি পাঁচটা গাছ দেখা যাচ্ছে, তাদের কাছেই জিজ্ঞেস করো, কেন এদেশে এই নিয়ম চালু হলো। নতুন বউ গাছের কাছে গেল এবং সব কথা খুলে বলল। গাছ-ও দুঃখ চেপে রেখে বলল, এখানে তিনটা মোটা গাছ ছিল। তারমধ্যে এখন একটা গাছ নেই। সেই বিরাট গাছটার গুঁড়ির কাছে একটা বড় গর্ত ছিল। যার মধ্যে একটা মানুষ ইচ্ছে করলে বিশ্রাম নিতে পারত। একদিন এক চোর বেচারা তাড়া খেয়ে প্রাণের ভয়ে গাছের ভেতর এসে লুকিয়ে পড়ল। বিপদে গাছের গর্তে জায়গা হলো চোরের।
অনেক চেষ্টা করেও কেউ-ই চোরকে খুঁজে পেল না। সে সারারাত সেখানে লুকিয়ে থেকে পরদিন বেরিয়ে গেলা। গাছটা ছিল চন্দনের থেকেও সুগন্ধা। রাতভর সেখানে লুকিয়ে থাকায় শরীর থেকে তখন ভুর ভুর করে গন্ধ বেরোচ্ছে। সে-ও হাঁটতে হাঁটতে এক গঞ্জে হাজির। সেখানকার লোকজন বলাবলি করছিলÑ বড় অদ্ভুত সুগন্ধ আপনার শরীরে। কী সুগন্ধী মেখেছেন?
চোর কোনো উত্তর দিলো না। কিন্তু লোকজন তাকে কিছুতেই ছাড়ল না। তাকে নিয়ে সোজা রাজার কাছে হাজির হলো। বলল, মহারাজ এখানে এমন লোককে এনেছি যার শরীর থেকে অদ্ভুত রকমের সুগন্ধ বেরোচ্ছে। কিন্তু তার সে আসল রহস্যটা বলছে না।

রাজার সেপাইরা সঙ্গে সঙ্গে লোকটাকে রাজসভায় ধরে নিয়ে এলো। রাজা বলল, এই সুগন্ধীর ব্যাপারটা যদি বলে দাও তাহলে তোমার পুরস্কার দেয়া হবে। আর যদি না বলো তা হলে তোমার গর্দান নেওয়া হবে। গর্দান যাবার ভয়ে, সে ফাঁস করে দিলো সুগন্ধের ব্যাপারটা। রাজা বলল, আমার লোকজনের সেই গাছটা দেখিয়ে দাও। তখন সে বনের মধ্যে গিয়ে গাছটা দেখিয়ে দিলো। অমনি রাজার লোকজন কুঠার দিয়ে গাছটা কেটে নিয়ে চলে গেল।
নতুন বউ স্বামীকে বাঁচাবার জন্য কাঁদো কাঁদো সুরে বলল, আমি তো আপনার কোনো উপকার করিনি তবে কেন আমার স্বামীকে খেয়ে আমাকে বিধবা করবেন। সাপটা বিরক্ত হয়ে বলল, অত সব বুঝি না, আমি তাকে খাবোই। তবে তোমাকে দুটো ওষুধ দেবো। এটা খেলে তোমার দুটো পুত্র সন্তান হবে। তাদের নিয়ে তুমি সুখে বাস করো। বউ বলল, আমি চাই না কোনো ওষুধ। আপনি আমার স্বামীকে খাবেন না ব্যস্। আমি একা শ্বশুরবাড়ি গেলে লোকে আমাকে মন্দ বলবে। শ্বাশুড়িসহ আশপামের লোকজন আমাকে অকর্মা বলবে। আপনি আমার স্বামীকে ক্ষমা করে দিন।

সাপ তখন গর্তে গিয়ে একটা চিকন শিকড় এনে বলল, যারা তোমাকে গালাগালি করবে, এই শিকড় তাদের মাথার ওপর ছড়িয়ে দিলে, দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠবে এবং সে পুড়ে মরে যাবে। বউ যেই শিকড়টা হাতে পেল, অমনি সাপের মাথার ওপর ধরে বলল, এইভাবে দিতে হবে? বলেই শিকড়টা সাপের মাথার ওপর ছড়িয়ে দিল। সাথে সাথে সাপের সারা শরীরে আগুন ধরে সাপ মারা গেল। তারপর বর-কনে ঘোড়ায় চেপে হাসতে হাসতে চলে গেল বাড়িতে।