একটি ইঁদুরের গল্প

আবুল খায়ের নাঈমুদ্দীন

0
113

তখন গভীর রাত। তাহমিনা চিৎকার করে কেঁদে উঠল- মা…গো মা, মা… গো মা হাউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল ‘মা আমাকে কিসে জানি কামড়াই দিছে’। তাড়াতাড়ি আসো না। বলতে বলতে কাঁদছে আর কাঁদছে। পাশে শোয়া দাদু তাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলেও সে মাকেই ডাকছে। মা অচেতন ঘুমের ঘোরে চিৎকার করে বলে উঠল.. আহারে! কী কয় আমার তামুর কী হলো? ও আল্ল­াহ কী কয়রে তামু! বলে জোরে জোরে চিৎকার করতে করতে রুম থেকে বেরিয়ে তাহমিনার খাটের কাছে এসে লাইট জ্বালিয়ে দেখলো সে ও তার দাদু বসে পা টিপে ধরে আছে। ওমা, ঠিকই তো তাহমিনার পায়ের আঙুলের পেটে কামড়ের দাগ। হালকা রক্তও বের হচ্ছে, ইশ্ মা তো ভয়ে কাহিল। সাপে কামড়ালো? নাকি পোকা মাকড়!
এমনিতেই টিনের ঘর, ঘরের চারপাশে গাছগাছালি। কী যে করা। এখন গভীর রাত হলেও তাহমিনা, তার মায়ের এবং শেষে তার দাদীর চেঁচামেচিতে ততক্ষণে বাড়ির সবাই জড়ো হয়ে গেছে। কেউ বলছে ডাক্তার ডাকো, কেউ বলছে রিফুজি লতার রসা দাও, কেউ বলে মরিচের গুঁড়া দাও, কেউ বলে হাসপাতালে নিয়ে চলো। এভাবে একেক জনের একেক মন্তব্য চলছে।

তাহমিনার বাবা ভালো করে দেখে আপাতত শান্তনা দিতে বলল, ধ্যাত কিচ্ছু হয়নি, সাধারণ কোনো পোকা না হয় ইঁদুরই হবে। সাপের কামড়ে দাঁত চারটাই থাকে এখানে কোনো দাঁতের চিহ্ন নেই। আর বিষ ব্যথাও কম, এটা কোনো ব্যাপার না। এ কথা শুনে তাহমিনার মা রেগে মেগে বললেনÑ তোমার কাছে কোনো ব্যাপার-ই না কিন্তু মাইয়্যাটা আমার শেষ হয়ে গেছে। কে জানে কী থেকে কী হয়? কে কাকে থামায়? তাহমিনার দাদী বলল সারা ঘর ভালো করে দেখ্ কিছু জন্তুটন্তু পাওয়া যায় কি না। তাহলে বুঝা যাবে কী ঘটেছে। সবাই মিলে সারা ঘর তন্ন তন্ন করে দেখছে আর শোরগোল করছে। ঘরের মাচার ওপরনিচ, কাঠের আলমিরার কোণে, ওপরে মাচাংয়ের পাশে, মোরগের খোঁয়াড়ে এমনকি ঘরের বাইরেও সব জায়গায় খুঁজে কিছু না পেয়ে এবার এসে মশারি ধরে টান দিতেই বিড়ালের মত করে লাফ দিয়ে সবার সামনেই বেরিয়ে গেল আস্ত বিরাট এক ইঁদুর। সবাই চিৎকার করে উঠল- ধর ধর। বললেই কি আর ধরা যায়, খুঁজেও পায়নি? মানুষ যখন দুশ্চিন্তায় মগ্ন থাকে তখন সহজ বুদ্ধিও হাতছাড়া হয়ে যায়।

সেই দিন থেকে ইঁদুর দেখলে বা ইঁদুরের নাম শুনলেই আঁতকে ওঠে তাহমিনা। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যায়। মশারির রশি পায়ে আটকে ছিল একদিন। তাতেই তার কী চিৎকার! তার পা নাকি ইঁদুর কামড়ে ধরেছে। আরেক রাত পড়তে পড়তে বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েছিল। রাতে তার পেন্সিলের মাথাটা পায়ে লাগার সাথে সাথে চিৎকার দিয়ে ওঠে। পরে লাইট জ্বালিয়ে দেখা গেল তার পায়ের সাথে পেন্সিলের চিকন মাথার গুঁতো লেগেছে। বিশেষ করে সেই রাতে যেখানে তাকে ইঁদুর কামড়ে দিয়েছিলো, সেই কামড়ের চিহ্ন এখনো বহাল আছে।

এখন সে রাতে একা পড়তেও বসে না। টেবিলের ওপাশ থেকে যদি ইঁদুরটা এসে কামড়ে দেয় আবার! আরে বাপরে, ইয়া বড় ইঁদুর! সে আর কখনো দেখেনি। তাহমিনা এবার থ্রি ক্লাসে উঠবে। ছাত্রী হিসেবেও ভালো। বাবা-মায়ের অনেক দোয়ার ফল এই একমাত্র মেয়ে। বেশ চুপচাপ থাকে, দাদুই একমাত্র সঙ্গী। দাদু হ্যামেলিনের বঁাঁশিওয়ালার গল্প বলে, ছড়া কাটে, মজার মজার পিঠা খাওয়ায়। দাদুরও একমাত্র সঙ্গী তাহমিনা। তাই ইঁদুরের বিষয়টি নিয়ে তাহমিনার দাদুর চিন্তা আরো বেশি। তিনি আগের কালের একটু শিক্ষিত। তাই ইঁদুর বিষয়ে গবেষণার শেষ নেইÑ ইঁদুরের সাইজ হতে পারে বড়জোর তিন বা চার ইঞ্চি, কিন্তু সাড়ে আট বা দশ ইঞ্চিও হওয়া সম্ভব। আমাদের দেশে ধান ক্ষেতের আইলে গর্ত করা সেই ইঁদুরগুলো বেশ বড়ই দেখা যায় কিন্তু ঘরের ইঁদুর তো এত বড় হয় না?
তিনি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন নিশ্চয়ই এটা ব্রিটিশ ইঁদুর, ব্রিটিশ বললে কম হবে। আমাদের দেশে কেউ বেশি চালাকি করলে তাকে গালিস্বরূপ বলা হয় ‘ব্রিটিশ’! কারণ ব্রিটিশরাই এই দেশটাতে ঘুষ, দুর্নীতি, প্রতারণা চুরি সব শিখিয়ে গেছে। এমনকি দেশের তিন পাশে ভারত রেখে ম্যাপও করে দিয়েছে। তিনি এখানেই ক্ষান্ত হননি। মন্তব্য করলেন, আমাদের দেশে সাদা সাদা বিশাল বিশাল যে গরু দেখা যায়, তা সব অস্ট্রেলিয়ার প্রজন্ম আমদানি। হয়তো কোনো এক সময় সেখান থেকে আমাদের দেশে উন্নত প্রজনন বীজ এসেছে, তার পর থেকে চলছে তো চলছেই। বিভিন্ন দেশের বিশাল বিশাল গাভী পালনেও কৃতিত্ব শুরু হয়েছে।

আবার দেশে এক রকম ছাগল পাওয়া যায়, যে ছাগলগুলো আস্ত পাথর গিলে খায়। সেগুলোকে পাটনাইয়া ছাগল বলে। বড় বড় রেলস্টেশনে থাকে। পুরা স্টেশন ঘুরতে তাদের কোনো টিকেট লাগে না। রেলের নিচে পড়ে কাটাও পড়ে না, বড়ই ধূর্ত। সেগুলো রেলের পাথর খেতেও কোনো বিল পরিশোধ করতে হয় না, মামলাও হয়না। বছরে কত টন পাথর খেয়ে শেষ করে কে জানে? অন্য দিকে বাজারে বড় বড় পাকিস্তানি মুরগি পাওয়া যায় কিন্তু এই ইঁদুরের জন্মসনদ কোথাকার কে বলবে?

ইঁদুরের বংশ যে দেশেরই হোক এ দেশে এ ঘরেই এলো কিভাবে? এই ইঁদুর তাহমিনাকে কামড়িয়েছে তার কতো বড়ো সাহস। এর আগে সে তামুর বই কেটেছে, ঈদের জামা কেটেছে, লেপ তোষক যে কতো কেটেছে তার হিসেব নেই। সে ঐ রাতে রাগে ফুঁঁসে উঠে বলেছিলÑ ইঁদুর, তোরে আমি খাইছি, তোরে দেখামু মজা। তখন তার বাবা তাকে কোলে নিয়ে শান্তনা দিতে দিতে বলেছিলেন আজ থেকে আমি আর তুমি ইঁদুরকে এই ঘর থেকে তাড়াবো- ঠিক আছে? তাহমিনা বলেছিল- হ্যাঁ আব্বু আজ থেকে যখনই সুযোগ পাবো তাদের পিটিয়ে পিটিয়ে শেষ করবো। বাবা বলেছিলেন- না, পেটাতে পারবে না কারণ তারা লুকিয়ে থাকে। বরং কৌশলে ধরতে হবে। এক ধরনের ইঁদুর মারার মেশিন আছে সেটা নিয়ে আসবো, তুমি শোয়ার আগে একটি বিস্কুট বসিয়ে দিলে যখনই ইঁদুর এসে বিস্কুট খেতে ঢুঁঁ মারবে ওমনি জায়গায় খতম হয়ে যাবে।
তাহমিনা বললÑ না না, আব্বু ও মারা গেলে তো আমি কাউকে দেখাতে পারবো না। খেলতেও পারবো না। তাকে জীবিত রাখতে হবে তাহলে মজা করে কামড়ানোর শিক্ষা দিতে পারবো। তামুর বাবা হেসে উঠে বলল, হুম তারও একটা উপায় আছে। কাল বাজার থেকে সেই যন্ত্রটাই নিয়ে আসবো, দেখবে মজা।
বাপ বেটি এবার একটু হাসলো, ঘরেও শোরগোল কমলো। এবার তামুর মা তামুকে মলমের কৌটা থেকে একটু মলম নিয়ে ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিলো। তারপর সেদিনকার মতো তামু তার দাদুর কোলের মাঝখানে শুয়ে পড়লো। দাদু ছড়া কাটলোÑ

‘কাটুস কুটুস কাটলি ইঁদুর দাদুমণির পা,
আর কাটিস না আর কাটিস না দূর যা দূর যা’।

তাহমিনা সকালে উঠে আবার চিৎকার শুরু করলো আব্বু আব্বু, আমি অনেক গুলো ইঁদুর ধরে ফেলবো। মা বাবা দু’জনেই শান্তনা দিয়ে বলল ঠিক আছে, ঠিক আছে। তামুর দাদু তামুকে বলল, যদি তুমি দু’তিনটা ইঁদুর মারতে পারো তাহলে তোমার পুরস্কার আছে। সে বলল, দাদু দেখিও, আমি অনেক গুলো ইঁদুর ধরতে পারবো।

পরদিন তার বাবা ইঁদুর নিধনের ওষুধ আনলো। কিন্তু দিনের পর দিন যাচ্ছে কোনো ইঁদুর মরছে না। প্রতিদিন সকালে সে ইঁদুর ধরার খাঁচা পরীক্ষা করে কিন্তু একটি ইঁদুরও দেখতে পায় না। অনেকটা নিরাশ হয়ে পড়ে। একদিন সকালে তাহমিনার মতিগতি দেখে তার বাবা আদর করতে করতে বললেন, তুমি ভেবো না, আজ অন্য এক ধরনের খাঁচা নিয়ে আসবো। আর সেটাতে ইঁদুর বেটা ধরা খাবেই। তাহমিনা প্রশ্ন করলো সেটা কেমন বাবা? বাবা উত্তরে বলল, সেটা তারের মতো শক্ত চার কোণাবিশিষ্ট একটি খাঁচা। মুখটা খুব সহজে আটকানো যায়। আর ভেতরে বিস্কুট বা শুকটি লাগানোর জন্য একটি ছোট শিক থাকে। সেখানে খাদ্য লাগিয়ে রাতে কোথাও বিছিয়ে রাখলে ইঁদুর বেটা সেটি খাওয়ার জন্য মুখ লাগালেই দরজাটায় টান পড়ে বন্ধ হয়ে যাবে। বেটা আর বের হতে পারবে না। মানুষের মধ্যেও অতি চালাকরা অন্যের ক্ষতি করে মনে করে সে বেঁচে গেছে কিন্তু এভাবেই একদিন না একদিন ধরা পড়েই। তামু হেসে বলল ঠিক আছে। রাতে আমিসহ খাঁচাটা বসিয়ে দেবো। এই বলে তামুর বাবা চলে গেল।

সারাদিন সে কতো কল্পনা করে সময় পার করেছে তার শেষ নেই। কতবার মাকে বলেছে রাত হয় না কেন? বাবা কখন আসবে। এভাবে রাত এলো আর রাতে বাবা ফিরে এলেন। রাতে বাবার ডাক শুনেই তাহমিনা দৌড় দিলো, আব্বু খাঁচা নিয়ে এসেছো? তাহমিনা দেখলো ছোট্ট একটি খাঁচা, হয়তো লম্বায় এক ফিট, আর প্রশস্ততায় পাঁচ ইঞ্চি হবে। খাঁচার ভেতরে বেশ বড় জায়গা। কয়েকটা ইঁদুর থাকতে পারবে। তাহমিনা মনে মনে ভাবে একসাথে অনেকগুলো ইঁদুর ধরা যাবে।

তারা দুজনে মিলে ভাবলো, অন্য জায়গায় খাঁচাটা বসিয়ে দেখা যাক সেই ইঁদুরটি ধরা যায় কি না? ঠিক মতো বাবা মেয়ে দেখে শুনে খাঁচার ভেতরের ছোট শিকটাতে একটি সুগন্ধি বিস্কুট লাগিয়ে দিলো। আর ইঁদুর মাচার যেখানে লাফালাফি বেশি করে সেখানেই খাঁচাটা বসিয়ে দিলো। তাহমিনা আবারো অনেক বিশ্বাস নিয়ে বললÑ আব্বু, দেখবা এবার ঠিকই অনেকগুলো ইঁদুর ধরা পড়বে।

কথার ভেতর দিয়ে দাদু তার রুম থেকে বললÑ আচ্ছা, তুমি কেমনে বলো অনেকগুলো ইঁদুর ধরে ফেলবে? তাহমিনা বললÑ দাদু আমি স্বপ্নে দেখেছি। দাদু হাসতে হাসতে বলল, ও তাই নাকি? আচ্ছা দেখা যাক। তবে ছোটদের স্বপ্ন কিন্তু সত্যি হয়ে যায়। তাহমিনা আরো লাফিয়ে ওঠার মতো করে বলল- সত্যি নাকি দাদু? তাহলে তো মজা হবে মজা। দাদী বললেন, দাদুমণি শোনো কারো কোনো ইচ্ছা যদি পূরণ করতে হয় তাহলে নামাজ পড়ে দোয়া করতে হয়। আজ রাতে আমার সাথে নামাজ পড়ে দোয়া করো দেখবে ইদুর তোমার খাঁচায় ধরা পড়বেই। নামাজের পর তাহমিনা দোয়া করলো আমি সেই ইঁদুরটি চাই যে আমাকে কামড়িয়েছে। দাদু বললেন, তাড়াতাড়ি শোও, আর ছড়া কাটতে কাটতে ঘুমাও। তাহলে দেখবা সবার আগে জাগতে পারবে। আর সকালে ঠিকই ইঁদুর দেখতে পাবে। তাহমিনা বলল- ঠিক আছে তুমি বলে দিও আমিও ছড়াটি শুনে শুনে বলবো। দাদু ছড়া বলতে শুরু করলÑ

‘বুড়ো ইঁদুরছানা ইঁদুর কোথায় আছো ভাই,
সারা ঘরে খুঁজে দেখি কোথাও তুমি নাই।
আমার দাদুর স্বপ্ন হয়ে ধরা দাও খাঁচায়,
খাঁচা আমি রাইখ্যা দিলাম ঘরেরই মাচায়’।
দু’জনে সমসুরে এই বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়লো।

তাহমিনা ভোরে আবার স্বপ্ন দেখলো সে অনেকগুলো ইঁদুরছানা দেখছে। আবার চিৎকার করে উঠল। দাদু ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো কি হলো আবার? সে কাউকে কিছু না বলে আস্তে আস্তে উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে গিয়ে সকালের আবছা আলোয় মাচায় দেখে এলাহি কা-। সেখান থেকেই আবার চিৎকার দিতে দিতে সবাইকে জড়ো করে ফেললো। সবাই ঐ দিনকার মতো বিপদ মনে করে দৌড়ে এলো। এসে দেখলো ইঁদুর নিধনের খাঁচার ভেতরে সেই বড় ইঁদুরটি অসহায়ের মতো দুর্বল হয়ে পড়ে আছে। আর তার চারপাশে আরো ছয়টি বাচ্চা জন্ম দিয়ে রেখেছে। সবাই তো অবাক! সাথে শোরগোল আর হাসিও সমান তালে চলল।