অথৈ নীলের দেশ

আবরার হক

0
76

অনুসন্ধিৎসু মনের একটা সাধারণ প্রশ্ন দিয়ে শুরু করি আজ। আচ্ছা, সাগরের পানি নীল কেন? আমরা তো পানিকে স্বচ্ছই দেখি সাধারণত। তাহলে সাগরে গেলে সেই পানিই কি নীল হয়ে যায়? আসলে পানি তো নীল হয় না, আমরা নীল দেখি। আলোর কারসাজির জন্যই এরকম ঘটে। একই কারণে আটলান্টিক মহাসাগরের পানি আবার সবুজ দেখায়।

পৃথিবীতে এমন মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে, সমুদ্রের এই অথৈ নীল পানি যাদের আকর্ষণ করে না। সাগরের পাড়ে দাঁড়িয়ে তার বিশালতার মাঝে হারিয়ে যাবার মতো আনন্দ খুব কমই অন্য কিছুতে পাওয়া যায়। এই বিশালতার আধার অথৈ নীলের দুনিয়া সম্পর্কেই আজ কিছু জানার চেষ্টা করি চলো।
গত সংখ্যার লেখায় আমরা বলেছিলাম, মহাসাগরগুলো পৃথিবীর বহিরাঙ্গনের প্রায় ৭১ শতাংশ জায়গাজুড়ে রয়েছে। কিন্তু জায়গা ৭১ শতাংশ নিলেও, পৃথিবীর মোট জীবম-ল বা প্রাণিম-লের ৯০ শতাংশই এই মহাসাগরগুলোতে আছে। পৃথিবীর মোট প্রাণীর ৯৭ শতাংশই এই মহাসাগরগুলো জুড়ে আছে। প্রায় ৩৬ কোটি ১০ লক্ষ বর্গকিলোমিটারের এই মহাসাগরগুলো ৫টি মহাসাগর আর বেশকিছু সাগর-উপসাগরে বিভক্ত।

এবার চলো আমরা জানার চেষ্টা করি, এই মহাসাগরগুলোতে কতো পানি আছে। হিসেবটা বেশ মজার, মনে করো কোনো কাঁচের বক্স, যার উচ্চতা, দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, সবই ১০ সেমি করে। তাহলে সেই পাত্রের আয়তন হলো ১০০০ কিউবিক সেমি। এরকম ১০০০ কিউবিক সেমি পাত্রে পানি ধরে ১ লিটার। এভাবে পৃথিবীর আয়তন অনুযায়ী সমুদ্রের গড় গভীরতাকে নিয়ে মাপলে দেখা যায়, মহাসাগরগুলোতে পানির পরিমাণ হয় প্রায় ১.৩৫ বিলিয়ন ট্রিলিয়ন লিটার। একটু ধাঁধাঁ লাগছে? সংখ্যাটা অঙ্কে লিখলে কেমন দেখায় দেখি। ১,৩৫০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০ লিটার। ১৩৫ এর পরে আরো ১৯টি শূন্য বসালে এই দানবীয় সংখ্যাটি পাওয়া যায়। কী বিশাল ব্যাপারস্যাপার, তাই না? ওশানোগ্রাফার বা মহাসাগরবিদরা বলছেনÑ এই বিশাল জলরাশির জগতের মাত্র ৫ শতাংশ সম্পর্কে তারা জানতে পেরেছেন। বাকি অংশ এখনো তাদেরও অজানাই রয়েছে।

সাম্প্রতিককালে তুমি শুনে থাকবে, ভবিষ্যতে পানি নিয়ে যুদ্ধ হতে পারে। সাগরের এই বিপুল জলরাশির পাড়ে দাঁড়িয়ে তোমার মনে হয়তো প্রশ্ন জাগতে পারে, এত পানি থাকতে পানি নিয়ে যুদ্ধ হবে কেন? একটা বিষয় জানলে তুমিও বাকি সবার মতো বিষয়টা বুঝতে পারবে। সাগরের পানিতে প্রায় ৩.৫ শতাংশ লবণ থাকে। অর্থাৎ তুমি যদি এক লিটার সাগরের পানি নাও, তাতে ৩৫ গ্রাম লবণ থাকবে। সাগরপাড়ের একটা বড় অংশ জনগোষ্ঠী সাগরের পানি থেকে লবণ আলাদা করে তা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। তুমি সী-বীচে গেলে সাগরের পানি মুখে নিয়ে দেখতে পারো, এই পানি খাবার উপযুক্ত না। এজন্যই মূলত এই মহাবিস্তৃত জলরাশি দিয়ে খাবার পানির অভাব পূরণ করা সম্ভব নয়।

মহাসাগরগুলোর নাম তো জানো। প্রশান্ত মহাসাগর, আটলান্টিক মহাসাগর, ভারত মহাসাগর, উত্তর বা আর্কটিক মহাসাগর এবং দক্ষিণ বা এন্টার্কটিকা মহাসাগর। প্রশান্ত মহাসাগরে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে গভীর স্থান মারিয়ানা ট্রেন্স। এই পরিখার গভীরতম জায়গার গভীরতা ১১,০৩৪ মিটার বা ৩৬,২০১ ফুট। পৃথিবীর উচ্চতম স্থান মাউন্টএভারেস্টকে এই খাদে স্থাপন করা হলেও, এর চূড়া সমুদ্রস্তরের ২ কিলোমিটারেরও বেশি গভীরে থাকবে। এমনিতে মহাসাগরগুলোর গড় গভীরতা প্রায় ৩.৭ কিলোমিটার।

এই বিশাল জলরাশি মানুষের জ্ঞাত প্রায় ২ লক্ষ ৩০ হাজার প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, সাগরের প্রাণকুলের বড় অংশই এখনো তাদের জানার বাইরে। সবমিলিয়ে এই সাগর ২০ লক্ষের বেশি প্রজাতির প্রাণীর আবাস বলেই তাদের ধারণা। বর্তমান পৃথিবীর বৃহত্তম প্রাণী নীল তিমি, যাদের দৈর্ঘ্য হয় প্রায় ৯৮ ফুট পর্যন্ত আর ওজন হয় ১৯১ টন পর্যন্ত, তার আবাস সাগরেই। গড়পড়তা এই তিমিগুলোর জিহ্বার ওজনই একেকটা আফ্রিকান হাতির ওজনের মতো হয়।

গত সংখ্যার লেখায় তোমাদের বলেছিলাম, আগে পৃথিবীর স্থলভাগ পুরোটা একত্রে ছিল, যেটাকে প্যানজিয়া মহাদেশ বলা হচ্ছে। তখন এই প্যানজিয়ার চারপাশে পানি দিয়ে ঘেরা ছিল। ওই মহাসাগরকে বলা হয় প্যানথালাসা। এরপর স্থলভাগগুলো বিভক্ত হতে থাকার কারণে ধীরে ধীরে মহাসাগরগুলোও বিভক্ত হতে থাকে। তবে এখনো মহাসাগর আর সাগর-উপসাগরগুলোকে একত্রে ওয়ার্ল্ড ওশান বা বিশ্ব মহাসাগর বলা হয়।

মহাসাগরে কিছু মাছ আছে যেগুলো অবিশ্বাস্য দ্রুত ছুটতে পারে। তুমি জেনে থাকবে, স্থলভাগের সবচেয়ে দ্রুতগামী প্রাণী চিতা ১২০.৭ কিমি পর্যন্ত ছুটতে পারে। জলভাগেও এমন দ্রুতগামী প্রাণী আছে। আটলান্টিক আর প্রশান্ত মহাসাগরে সেইল ফিশ আছে, যেগুলো ১০৯.৪ কিমি পর্যন্ত ছুটতে পারে। অনেকের মতে স্ট্রিপড মারলিন সবচেয়ে দ্রুতগামী মাছ, এদের সর্বোচ্চ গতি রেকর্ড করা হয়েছে ১২০ কিলোমিটার।

পৃথিবীর তিন ধরনের জায়গায় সবচেয়ে বেশি প্রাকৃতিক সম্পদ লুকানো থাকে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মহাসাগর। মহাসাগরগুলোর উপরিভাগ দেখে তাকে কেবল নীলের সাম্রাজ্য মনে হলেও এর নিচে ডুব দিলে এর রূপবৈচিত্র দেখে অবাক হয়ে যেতে হয়। সাগরতলে অসংখ্য প্রজাতির প্রাণী আছে, যাদের শরীর দেখে মনে হয় রঙের বুঝি মেলা বসেছে। এখানে এত মাছের ছবি বা বিবরণ কোনোটাই দেয়া যাচ্ছে না। তাই তোমাদের দেখার ও জানার সুবিধার্থে আমি কিছু অনিন্দ্যসুন্দর মাছের নাম এখানে দিয়ে যাচ্ছি, যেগুলো লিখে নেটে সার্চ করলেই তোমার চোখ জুড়িয়ে যাবে। Mandarinfish, Flowerhorn Cichlid, Juvenile Emperor Angelfish, Symphysodon Discus Fish, Clown Triggerfish, Rainbow Parrotfish, Peacock Cichlid, Clownfish, Killifish, Golden Sailfin Molly, Electric Blue Ram, Royal Gramma, Crowntail Betta, Candz Basslet, Parrot Fish, Moorish Idol, Regal Tang, Arabian Angelfish, Yellow Butterflyfish, Picasso Triggerfish প্রভৃতি অসংখ্য নাম এভাবে লেখা যাবে। তুমি আপাতত এগুলো দেখেই মন ভরাও।

স্থলভাগে যেমন উঁচুনিচু, পাহাড় পর্বত ইত্যাদি রয়েছে, তেমনি সাগরের তলদেশও এভাবে বিচিত্র ধরণের ভূমি দিয়ে গঠিত। সাগরতলে রয়েছে প্রকৃতির অনন্যসুন্দর সৃষ্টি প্রবাল আর প্রবালপ্রাচীর। সাগরতলের সৌন্দর্যের একটা বড় অংশই এই প্রবালকে ঘিরে। প্রবাল আর প্রবালপ্রাচীর কী জিনিস
তা একটু জানার চেষ্টা করি চলো। ইংরেজিতে এদের বলা হয় কোরাল। প্রবাল বা কোরাল আসলে এক ধরনের সামুদ্রিক প্রাণী। তবে অন্যান্য সামুদ্রিক মাছের সাথে এর একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। অন্যান্য প্রাণী যেখানে ছোটাছুটি করে খাবার সংগ্রহ করে, সেখানে এই প্রাণীগুলো পূর্ণবয়স্ক অবস্থায় সাগরতলের কোনো মজবুত তলের ওপর আবাস গেড়ে নিশ্চল অবস্থাতেই সেখানে বাকি জীবন পার করে দেয়। এই অবস্থাতেই তাদের জীবনকাল শেষ হয়ে গেলে তার ওপর নতুন করে প্রবাল আবাস গড়ে ওঠে। এভাবে ধীরে ধীরে সেখানে প্রবালপ্রাচীর গড়ে ওঠে।

সামুদ্রিক জীবনযাত্রায় প্রবালপ্রাচীর বেশ গুরুত্বপূর্ণ। প্রবালপ্রাচীরের জীববৈচিত্র্যের জন্য অনেক সময় একে সাগরের রেইনফরেস্ট হিসেবেও ডাকা হয়। কারণ সাগরে বসবাসকারী মোট জীবকুলের প্রায় এক-চতুর্থাংশের আবাসস্থল হলো প্রবালপ্রাচীর। এছাড়া অপরিপক্ক প্রবালকে অনেকেই খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে। এরকম বিভিন্নভাবে নানা ধরনের জলজ প্রাণী, পোকা, শামুক ও তারামাছ প্রবালের ওপর নির্ভরশীল। জাতিসংঘের ২০০১ সালের এক হিসাবানুযায়ী, পৃথিবীতে প্রবালপ্রাচীরের মোট বিস্তৃত ক্ষেত্রফল ২,৮৪,৩০০ বর্গ কিলোমিটার। কোনোভাবে কোনো সামুদ্রিক প্রবালপ্রাচীরে যদি ঘুরে আসার সুযোগ পাও, তাহলে ওপরে যে অসম্ভব সুন্দর মাছগুলোর কথা বললাম, সেগুলোর অনেকগুলোরই দেখা পেয়ে যেতে পারো।

এরকম পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রবালপ্রাচীরের অবস্থান অস্ট্রেলিয়ার উত্তর-পূর্ব উপকূলে। প্রায় ২,৫০০ থেকে ২,৯০০টি একক প্রবাল প্রাচীরের সমন্বয়ে গঠিত, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ এই প্রবালপ্রাচীরের ‘দ্য গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ’। ৪০০ রকমের প্রবাল, ১,৫০০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ আর চার হাজারের অধিক প্রজাতির প্রাণী এই প্রবাল প্রাচীরকে করেছে জীববৈচিত্র্যের স্বর্গ।

মহাসাগরে কিছু কিছু জায়গা আছে, যেগুলো রহস্যে আবৃত। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছে বারমুডা ট্রায়াঙ্গল। কিউবার পূর্ব দিকে এটি অবস্থিত। এরকম আরেকটি জায়গা হলো তাইওয়ান আর ফিলিপাইনের পূর্ব দিকের ড্রাগন ট্রায়াঙ্গল। এসব এলাকার ওপর দিয়ে যাবার সময় ছোট বড় অনেক নৌকা আর জাহাজ এমনকি উড়োজাহাজও গায়েব হয়ে গেছে।

আমাদের এবারের লেখা শেষ করবো অত্যন্ত ইন্টারেস্টিং একটা তথ্য দিয়ে। জুলভার্র্নের নাম শুনেছ নিশ্চয়ই। তার অসম্ভব জনপ্রিয় একটি উপন্যাস হলো জার্নি টু দ্যা সেন্টার অফ দ্যা আর্থ। না পড়ে থাকলে পড়ে ফেলতে পারো। এই লেখায় পৃথিবীর অভ্যন্তরে একটি সাগরের অস্তিত্বের কথা বলা হয়েছে। বর্তমানে বিজ্ঞানীরাও তাদের সবচেয়ে সাম্প্রতিক গবেষণায় তেমন কিছুরই চিহ্ন খুঁজে পেয়েছেন। ভাবো তো ব্যাপারটা! উপরের এই নীল জলরাশি নিয়ে গবেষণা করেই কুল করা যাচ্ছে না। ভেতরে আরেকটি বিশাল সাগর পাওয়া গেলে কী হবে তখন। তোমাদের ভাবনার জগতে রেখে আজ আমি এখানেই বিদায় নিচ্ছি। ভালো থেকো। আর হ্যাঁ, অবশ্যই আশেপাশের সবাইকে নিয়েই ভালো থেকো। আল্লাহ হাফেজ।